উত্থান (প্রবোধিনী)একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য ও পারণের সময়সূচি জেনে নিন

হরেকৃষ্ণ পাঠক বন্ধুরা🙏 সবাইকে নমস্কার। আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় সবাই ভালো আছেন। কার্ত্তিক মাসের শুক্লাপক্ষীয়া একাদশীর নাম উত্থান একাদশী। এই একাদশীত তিথিতে ভগবান জাগরিত হন বলে এর নাম উত্থান একাদশী। আগামী ১২ ই নভেম্বর রোজ মঙ্গলবার আমাদের পালন করতে হবে এই অতি পবিত্র উত্থান একাদশী ব্রত। এই একাদশী ব্রত নিষ্ঠার সাথে পালন করলে এক হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ ও শত শত রাজসূয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়। একাদশী ব্রত পালন করে একাদশী মাহাত্ম্য  পাঠ ও শ্রবণ করলে শ্রী হরির কৃপা লাভ ও সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়া যায়। বন্ধুরা আজ আমরা আপনাদের জানাবো অতি পবিত্র উত্থান একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য, একাদশী ব্রত পালনের নিয়মাবলী,একাদশীতে নিষিদ্ধ খাদ্যশস্য,পরের দিন পারণের সময়সূচী ও পারণের মন্ত্র।

ekadoshi

বন্ধুরা,সঙ্কটজনক অবস্থা বা জন্মমৃত্যুর অশৌচ কালেও কখনো একাদশী ব্রত পরিত্যাগ করতে নেই। একাদশীতে শ্রাদ্ধ উপস্থিত হলে সেইদিন না করে দ্বাদশীতে শ্রাদ্ধ করা উচিত। শুধু বৈষ্ণবেরাই নয়, শিবের উপাসক, সূর্য-চন্দ্র-ইন্দ্রাদি যেকোন দেবোপাসক, সকলেরই কর্তব্য একাদশী ব্রত পালন করা।

উত্থান (প্রবোধিনী) একাদশী মাহাত্ম্য:

কার্তিক সাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর মাহাত্ম্য স্কন্দপুরাণে ব্রহ্মা-নারদ সংবাদে বর্ণিত আছে। মহারাজ যুধিষ্ঠির বললেন- হে পুরুষোত্তম! কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম আমার কাছে কৃপা করে বর্ণনা করুন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে রাজন! কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী ‘উত্থান’ বা ‘প্রবোধিনী’ নামে খ্যাত।

প্রজাপতি ব্রহ্মা পূর্বে নারদের কাছে এই একাদশীর মহিমা কীর্তন করেছিলেন। এখন তুমি আমার কাছেসেকথা শ্রবণ কর। দেবর্ষি নারদ প্রজাপতি ব্রহ্মাকে বললেন- হে মহাত্মা! যে একাদশীতে ভগবান শ্রীগোবিন্দ শয়ন থেকে জেগে ওঠেন, সেই প্রবোধিনী বা উত্থান একাদশীর মহিমা আমার কাছে সবিস্তারে কীর্ত্তন করুন। ব্রহ্মা বললেন- হে নারদ! উত্থান একাদশী যথার্থই পাপনাশিনী,পূণ্যবর্ধিনী ও মুক্তিপ্রদায়ী। এই একাদশী ব্রত নিষ্ঠার সাথে পালন করলে এক হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ ও শত শত রাজসূয় যজ্ঞের ফল অনায়াসে লাভ হয়। 

আরো পড়ুনঃ ২০২৪ সালের কাত্যায়নী পূজার সময়সূচি

জগতের দুর্লভ বস্তুর প্রাপ্তির কথা আর কি বলব! এই একাদশী ভক্তিপরায়ণ ব্যক্তিকে ঐশ্বর্য্য, প্রজ্ঞা, রাজ্য ও সুখ প্রদান করে। এই ব্রতের প্রভাবে পর্বত প্রমাণ পাপরাশি বিনষ্ট হয়ে যায়। যারা একাদশীতে রাত্রি জাগরণ করেন, তাদের সমস্ত পাপ ভস্মীভূত হয়। শ্রেষ্ঠ মুনিগণ তপস্যার দ্বারা যে ফল করেন, এই ব্রতের উপবাসে তা পাওয়া যায়। যথাযথভাবে এই ব্রত পালন করলে আশাতীত ফল লাভ হয়। কিন্তু অবিধিতে উপবাস করলে স্বল্পমাত্র ফল প্রাপ্তি হয়। যারা এই একাদশীর ধ্যান করেন, তাদের পূর্বপুরুষেরা স্বর্গে আনন্দে বাস করেন। 

এই একাদশী উপবাস ফলে ব্রহ্মহত্যা জনিত ভয়ঙ্কর নরকযন্ত্রণা থেকে নিস্তার পেয়ে বৈকুন্ঠগতি লাভ হয়। অশ্বমেধ যজ্ঞ দ্বারাও যা সহজে লাভ হয় না, তীর্থে স্বর্ণ প্রবৃতি দান করলে যে পুণ্য অর্জিত হয়, এই উপবাসের রাত্রি জাগরণে সেই সকল অনায়াসে লাভ হয়ে যায়। যিনি সঠিকভাবে উত্থান একাদশীর ব্রত অনুষ্ঠান করেন, তার গৃহে ত্রিভুবনে সমস্ত তীর্থ এসে উপস্থিত হয়। হে নারদ! বিষ্ণুর প্রিয়তমা এই প্রবোধিনী একাদশীর উপবাস করলে সর্বশাস্ত্রে জ্ঞান ও তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে চরমে মুক্তি লাভ হয়। যিনি সমস্ত লৌকিক ধর্ম পরিত্যাগ করে ভক্তিভরে এই ব্রত উপবাস করেন, তকে আর পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে হয় না। 

আরো পড়ুনঃ শ্রীদামোদরাষ্টকম্ ও গোস্বামী গণের বিগ্রহদের নামস্মরণ

এমনকি মন ও বাক্য দ্বারা অর্জিত পাপরাশিও শ্রীগোবিন্দের অর্চনে বিনষ্ট হয়েযায়। হে বৎস! এই ব্রতে শ্রদ্ধা সহকারে শ্রীজনার্দনের উদ্দেশ্যে স্নান, দান, জপ, কীর্তন ও হোমাদি করলে অক্ষয় লাভ হয়। যারা উপবাস দিনে শ্রীহরির প্রতি ভক্তিভাবে দিনযাপন করেন, তাদের পক্ষে জগতে দুর্লভ বলে আর কিছু নেই। চন্দ্র ও সূযগ্রহণে স্নান করলে যে পুণ্য হয় এই উপবাসে রাত্রি জাগরণে তার সহস্রগুণ সুকৃতি লাভ হয়। তীর্থে স্নান, দান, জপ, হোম ধ্যান আদির ফলে যে পুণ্য সঞ্চিত হয়, উত্থান একাদশী না করলে সে সমস্ত নিষ্ফল হয়ে যায়। হে নারদ! শ্রীহরিবাসরে শ্রীজনার্দনের পূজা বিশেষ ভক্তিসহকারে করবে। তা না হলে শতজন্মার্জিত পুণ্যও বিফল হয়।

 হে বৎস! যিনি কার্তিক মাসে সর্বদা ভাগবত শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করেন, তিনি সর্বপাপ মুক্ত হয়ে সমস্ত যজ্ঞের ফল লাভ করেন। ভগবান হরিভক্তিমূলক শাস্ত্রপাঠে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। কিন্তু দান, জপ, যজ্ঞাদি দ্বারা তেমন প্রীত হন না। এই মাসে শ্রীবিষ্ণুর নাম, গুণ, রূপ, লীলাদি শ্রবণ- কীর্তন অথবা শ্রীমদ্ভাগবত আদি শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠের ফলে শত শত গোদানের ফল অচিরেই পাওয়া যায়। অতএব হে মুনিবর! কার্তিক মাসে সমস্ত গৌণধর্ম বর্জন করে শ্রীকেশবের সামনে হরিকথা শ্রবণ কীর্তন করা কর্তব্য। 

কোন ব্যক্তি যদি ভক্তিসহকারে এই মাসে ভক্তসঙ্গে হরিকথা শ্রবণ ও কীর্তন করেন, তবে তাঁর শতকুল উদ্বার প্রাপ্ত হন এবং হাজার হাজার দুগ্ধবতী গাভী দানের ফল অনায়াসে লাভ করেন। এই মাসে পবিত্রভাবে শ্রীকৃষ্ণের রূপ, গুণাদির শ্রবণ- কীর্তনে দিনযাপন করলে তার আর পুণর্জন্ম হবে না। এই মাসে বহু ফলমূল, ফুল, অগুরু, কর্পূর, ও চন্দন দিয়ে শ্রীহরির পুজা করা কর্তব্য। সমস্ত তীর্থ ভ্রমণ করলে যে পুণ্য সঞ্চয় হয়, উত্থান একাদশীতে শ্রীকৃষ্ণ পাদপদ্মে অর্ঘ্য প্রদানে তার কোটিগুণ সুকৃতি অর্জিত হয়। শ্রবণ- কীর্তন, স্মরণ, বন্দনাদি নববিধা ভক্তির সাথে তুলসীর সেবার জন্য যারা বীজ রোপন, জলসেচন ইত্যাদি করেন, তারা মুক্তিলাভ করে বৈকুন্ঠবাসী হন। হে নারদ! সহস্র সুগন্ধী পুষ্পে দেবতার অর্চনে বা সহস্র সহস্র যজ্ঞ ও দানে যে ফল লাভ হয়, এই মাসে শ্রীহরিবাসরে একটি মাত্র তুলসী পাতা শ্রীভগবানের চরণকমলে অর্পণ করলে তার অনন্তকোটিগুণ ফল লাভ হয়।

আরো পড়ুনঃ শ্রীকৃষ্ণের প্রণাম মন্ত্র ও অষ্টোত্তর শতনাম

একাদশী ব্রত পালনের নিয়মাবলী :

১। সমর্থ পক্ষে দশমীতে একাহার, একাদশীতে নিরাহার ও দ্বাদশীতে একাহার করিবেন।

২। তা হতেও অসমর্থপক্ষে শুধুমাত্র একাদশীতে অনাহার।

৩। যদি উহাতেও অসমর্থ হন একাদশীতে পঞ্চ রবিশষ্য বর্জন করতঃ ফল মূলাদি অনুকল্প গ্রহণের বিধান রহিয়াছে। সমর্থ পক্ষে রাত্রি জাগরণের বিধি আছে।

গৌড়ীয় ধারায় বা মহান আচার্যবৃন্দের অনুমোদিত পঞ্জিকায় যে সমস্ত একাদশী নির্জলা (জল ব্যতীত) থেকে পালনের নির্দেশ প্রদান করেছেন। সেগুলি করলে সর্বোত্তম হয়। নিরন্তর কৃষ্ণভাবনায় থেকে নিরাহার থাকতে অপারগ হলে নির্জলাসহ অন্যান্য একাদশীতে কিছু সবজি ফল মূলাদি গ্রহণ করতে পারেন। যেমন-গোল, আলু, মিষ্টি আলু ও চাল কুমড়া, পেঁপে, টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি সবজি ঘি, বাদাম তৈল অথবা সূর্যমুখি তেল দিয়ে রান্না করে ভগবানকে উৎসর্গ করে আহার করতে পারেন। জিরা, ধনিয়া, আদা, তেজপত্র, লবন ও মরিচ ব্যবহার্য। আবার অন্যান্য আহার্য যেমন- দুধ, কলা, আপেল,কমলা, আঙ্গুর, আনারস, আখ, আমড়া, শশা, তরমুজ, বেল, নারিকেল, মিষ্টি আলু, বাদাম ও লেবুর শরবত ইত্যাদি ফল মূলাদি খেতে পারেন।

একাদশীতে নিষিদ্ধ খাদ্যশস্য :

★ ধান জাতীয় - 

চাল,মুড়ি,চিড়া,খই, শ্যামাচাল,কাউন ইত্যাদি। 

★ গম জাতীয় -  

আটা,ময়দা,সুজি,পউরুটি,হরলিক্স,বিস্কুট ইত্যাদি। 

★যব/ভূট্টা জাতীয় -

ছাতু,ভুট্টার খই ইত্যাদি। 

★ ডাল জাতীয় -

সব ধরনের ডাল। 

★ সবজি জাতীয় - 

বরবটি, শিম,মটরশুঁটি, বেগুন,টমেটো, গাজর,মূলা ইত্যাদি। 

★ তৈল জাতীয় - 

সরিষা তেল,সয়াবিন তেল,তিল তেল ইত্যাদি।

উপরোক্ত পঞ্চরবি শস্যের যে কোন একটি একাদশীতে গ্রহণ করলে ব্রত ভঙ্গ হবে। উল্লেখ্য যারা সাত্ত্বিক আহারী নন এবং চা, বিড়ি/সিগারেট, পান, কফি ইত্যাদি নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেন একাদশী ব্রত পালনের সময় ঐগুলি গ্রহণ না করাই উত্তম। 

আরো পড়ুনঃ গাজরের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে জানুন

একাদশী করলে যে কেবলমাত্র নিজের জীবনের সদগতি হবে তা নয় নিজের প্রয়াত পিতা/মাতা নরকবাসী হলে তারাও নরক থেকে উদ্ধার পাবে। যদি কেউ কোন বিধি নিষেধ পালন ছাড়া উদ্দেশ্যহীন ভাবেও একাদশী থাকে তবে ঐ ব্যক্তির একাদশীর সম্পূর্ণ ফল পাবে। একাদশীতে অন্ন ভোজন করলে এবং অন্যকে করালেও নরকগতি হবে। পঞ্জিকাতে একাদশী পারণের যে সময় দেওয়া থাকে সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে নিবেদন করে প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা বিধেয়। নতুবা একাদশীর কোন ফল লাভ হয় না।

পারণের সময়সূচী :

১৫ ই নভেম্বর রোজ বুধবার সকাল ৬.১৯মিনিট হতে ৯.৪৫ মিনিটের মধ্যে। 


পারণ মন্ত্র :

একাদশ্যাং নিরাহারো ব্রতেনানেন কেশব। 

প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভাব।। 

এই মন্ত্র পাঠ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পারণ করতে হয়।  

প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, আশা করি আপনারা সবাই ভগবান শ্রী হরির কৃপা পেতে নিষ্ঠা ও ভক্তির সাথে উত্থান একাদশী ব্রত পালন করবেন। ভগবানের কৃপায় সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। সবাইকে ধন্যবাদ। রাধে রাধে 🙏

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url