পবিত্রারোপিণী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য এবং পারণের সময়সূচি
হরেকৃষ্ণ পাঠক বন্ধুরা🙏 সবাইকে নমস্কার। আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় সবাই ভালো আছেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষীয় একাদশীর নাম অপরা। আগামী ৩ রা এপ্রিল রোজ সোমবার আমাদের পালন করতে হবে এই অতি পবিত্র অপরা একাদশী ব্রত। এই ব্রত পালনকারী ব্যক্তি জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সনাতন ধর্ম অনুসারে একাদশী তিথি অতি পূণ্য প্রীতি হিসেবে বিবেচিত। কেননা এই তিথি ভগবানের প্রিয় তিথি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ৮ থেকে ৮০ বছর বয়সের যেকোনো ব্যক্তির ভক্তি সহকারে পবিত্র একাদশী ব্রত পালন করা কর্তব্য। একাদশী ব্রত পালন করে একাদশী মাহাত্ম্য পাঠ ও শ্রবণ করলে শ্রী হরির কৃপা লাভ ও সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়া যায়। বন্ধুরা আজ আমরা আপনাদের জানাবো অতি পবিত্র পবিত্রারোপিণী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য, একাদশী ব্রত পালনের নিয়মাবলী,একাদশীতে নিষিদ্ধ খাদ্যশস্য,পরের দিন পারণের সময়সূচী ও পারণের মন্ত্র।
বন্ধুরা, আমাদের একাদশী ব্রত পালনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নিরন্তন ভগবানকে স্মরণ করা। এই ব্রত পালনে যে ফল লাভ হয় তা অশ্বমেধ,রাজসূয় ও বাজপেয় যজ্ঞ দ্বারা হয় না। এই দিন ভাগবত শ্রবণে পৃথিবী দানের ফল লাভ হয়। আসুন জেনে নেই অতি পবিত্র পবিত্রারোপণী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য -
পবিত্রারোপনী একাদশী মাহাত্ম্যঃ
একদিন মহারাজ যুধিষ্ঠির ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন হে প্ৰভু ! শ্ৰাবণ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম কি তা কৃপা করে আমাকে বলুন ।
শ্ৰীকৃষ্ণ বললেন - হে মহারাজ ! এখন আমি সেই পবিত্ৰ ব্ৰত মাহাত্ম্য বৰ্ণনা করছি , মনোযোগ দিয়ে তা শ্ৰবণ করুন । যা শোনামাত্ৰেই বাজপেয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়।"প্ৰাচীন কালে দ্বাপর যুগের শুরুতে মহিজীৎ নামে এক বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তিনি মাহিম্মতি নগরে রাজত্ব করতেন।কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে তার মনে বিন্দুমাত্ৰ সু- শাস্তি ছিল না । কেননা তিনি ছিলেন অপুত্ৰক । পুত্ৰহীনের ইহলোক পরলোক কোথাও সুখ হয় না ”। এইরুপ চিন্তা করতে করতে বহুদিন কেটে গেল । কিন্তু তবুও পুত্ৰমুখ দশনে রাজা বঞ্চিতই রইলেন । নিজেকে অত্যন্ত দুৰ্ভাগা মনে করে রাজা চিন্তাগ্ৰস্ত হলেন । প্ৰজাদের সামনে গিয়ে বলতে লাগলেন, ''হে প্ৰজাবৃন্দ । তোমরা শোন । আমি এই জন্মে তো কোন পাপকাজ করিনি , অন্যায়ভাবে আমার রাজকোষ বৃদ্ধি করিনি , ব্ৰাহ্মণ বা দেবতাদের সম্পদ কখনও গ্ৰহণ করিনি উপরন্তু প্ৰজাদেরকে পুত্রের মতো পালন করেছি , ধৰ্ম অনুযায়ী পৃথিবী শাসন করেছি । দুষ্টদের যথানুরুপ দণ্ড দিয়েছি , সজ্জন ব্যক্তিদের যথাযোগ্য সন্মান করতেও কখনও অবহেলা করিনি । তাই হে ব্ৰাহ্মণগণ , এই প্ৰকার ধৰ্মপথ অবলম্বন করা সত্ত্বেও কেন আমার পুত্ৰ লাভ হল না , তা আপনারা কৃপা করে অনুসন্ধান করন''।
আরো পড়ুনঃ কয়েক সেকেন্ডে জেনে নিন আপনার ব্যবহৃত ফোনটি 5G সাপোর্ট করে কি না
রাজার এই প্ৰকার কাতর উক্তি শ্ৰবণে ব্যথিত রাজভক্ত পুরোহিত ব্ৰাহ্মণগণ রাজার মঙ্গলের জন্য গভীর বনে ত্ৰিকালজ্ঞ মুনিঋষির কাছে যেতে মনস্থ করলেন । বনের মধ্যে ঋষিদের আশ্ৰমসকল দেখতে দেখতে তারা এক মুনির সন্ধান পেলেন । তিনি দীৰ্ঘায়ু , নীরোগ নিরাহারে ঘোর তপস্যায় মগ্ন ছিলেন । সর্বশাস্ত্ৰ বিশারদ ধৰ্মতত্ত্বজ্ঞ ও ত্রিকালজ্ঞ সেই মহামুনি লোমশ নামে পরিচিত । ব্ৰহ্মার এক কল্প অতিবাহিত হলে মুনিবরের গায়ের একটি লোম পরিত্যক্ত হোত । এই কাণে এই মহামুনির নাম লোমশ । তাকে দেখে সকলেই ধন্য হলেন । তারা পরস্পর বলতে লাগলেন যে , আমাদের বহু জন্মের সৌভাগ্যের ফলে আজ আমরা এই মুনিবরের সাক্ষাৎ লাভ করলাম । তারপর মুনিবর তাদের সম্বোধন করে বললেন কি কারণে আপনারা এখানে এসেছেন এবং কেনই বা আমার এত প্ৰশংসা করছেন , তা স্পষ্ট করে বলুনা আপনাদের যাতে মঙ্গল হয় , আমি নিশ্চয়ই তার চেষ্টা করব । ব্ৰাহ্মণেরা বললেন হে ঋষিবর । আমরা যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি আপনি তা কৃপা করে শুনুন ।
এ পৃথিবীতে আপনার মতো শ্ৰেষ্ঠ ব্যক্তি আর কোথাও নেই । মহীজিৎ নামে এক রাজা নিঃসন্তান হওয়ায় অতি দুঃখে দিনযাপন করছে । আমরা তার প্রজা , তিনি আমাদেরকে পুত্রের মতো পালন করেন । কিন্তু তিনি পুত্ৰহীন বলে আমরা সবাই মর্মাহত। তার দুঃখ দূর করতে আমরা এই বনে প্ৰবেশ করেছি । হে ব্ৰাহ্মাণশ্ৰেষ্ঠ । রাজা যাতে পুত্রের মুখ দৰ্শন করতে পারেন , কৃপা করে তার কোন উপায় আমাদের বলুন । তাদের কথা গুনে মুনিবার ধ্যানমগ্ন হলেন । কিছু সময় পরে রাজার পূর্বজন্মবৃত্তান্ত বলতে লাগলেন । এই রাজা পূৰ্ব্বজন্মে এক দরিদ্র বৈশ্য ছিলেন । একবার তিনি একটি অন্যায় কাৰ্য করে ফেলেন । ব্যবসা করবার জন্য তিনি এক গ্ৰাম থেকে অন্য গ্ৰামে যাতায়াত করতেন। এক সময় তিনি শুক্লাপক্ষের দশমীর দিনে কোথাও যাওয়ার পথ্র তিনি অত্যন্ত তৃষার্ত হয়ে পড়েন । গ্ৰাম প্ৰান্তে একটি জলাশয় দেখতে পান । সেখানে জলপানের জন্য যান । সেই সময় একটি গাভী নানা জলপান করছিল । তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে তিনি নিন জলপান কাজে লাগলেন। এই পাপকর্মের ফলে তিনি পুত্ৰসুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু পূৰ্ব্বজন্মের কোন পুণ্যের ফলে তিনি এইরকম নিষ্কণ্টক রাজ্য লাভ করেছেন। ''হে মুনিবর। শাস্ত্ৰে আছে যে পুণ্য দ্বারা পাপক্ষয় হয় । তাই আপনি এমন একটি পুন্য ব্রতের উপদেশ করুন যাতে তার পারব্দ পাপ দূর হয় এবং আপনার অনুগ্রহে তিনি পুত্ৰসন্তান লাভ করতে পারেন''।
আরো পড়ুনঃ হার্টকে সুস্থ রাখতে এই ৭ টি খাবার থেকে দূরে থাকুন-
লোমশ মুনি বললেন ''শ্ৰাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পবিত্ৰারোপণী একাদশী ব্ৰত অভিষ্ট ফল প্ৰদান করে । আপনারা যথাবিধি তা সকলে পালন করুন'' । লোমশ মুনির উপদেশ শুনে আনন্দ চিত্তে গৃহে প্ৰত্যাবর্তন করে তঁরা রাজাকে সে সকল কথা জানালেন । তারপর সকলে মিলে মুনির নিৰ্দেশ অনুসারে ব্ৰত পালন করলেন । তাদের সকলের পুণ্যফল রাজ্যকে প্ৰদান করলেন। সেই পুণ্য প্ৰভাবে রাজমহিষী গৰ্ভবতী হলেন । উপযুক্ত সময়ে বলিষ্ঠ , সৰ্বাঙ্গসুন্দর এক পুত্ৰসন্তানের জন্ম দান করলেন । ভবিষোত্তরপুরাণে এই মাহাত্ম্য বৰ্ণিত হয়েছে । এই ব্ৰত মাহাত্মা যিনি পাঠ বা শ্ৰবণ করবেন তিনি সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হবেন এবং পুত্ৰসুখ ভোগ করে অবশেষে দিব্যধাম প্ৰাপ্ত হবেন।"
একাদশী ব্রত পালনের নিয়মাবলী :
১। সমর্থ পক্ষে দশমীতে একাহার, একাদশীতে নিরাহার ও দ্বাদশীতে একাহার করিবেন।
২। তা হতেও অসমর্থপক্ষে শুধুমাত্র একাদশীতে অনাহার।
৩। যদি উহাতেও অসমর্থ হন একাদশীতে পঞ্চ রবিশষ্য বর্জন করতঃ ফল মূলাদি অনুকল্প গ্রহণের বিধান রহিয়াছে। সমর্থ পক্ষে রাত্রি জাগরণের বিধি আছে। গৌড়ীয় ধারায় বা মহান আচার্যবৃন্দের অনুমোদিত পঞ্জিকায় যে সমস্ত একাদশী নির্জলা (জল ব্যতীত) থেকে পালনের নির্দেশ প্রদান করেছেন। সেগুলি করলে সর্বোত্তম হয়। নিরন্তর কৃষ্ণভাবনায় থেকে নিরাহার থাকতে অপারগ হলে নির্জলাসহ অন্যান্য একাদশীতে কিছু সবজি ফল মূলাদি গ্রহণ করতে পারেন। যেমন-গোল, আলু, মিষ্টি আলু ও চাল কুমড়া, পেঁপে, টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি সবজি ঘি, বাদাম তৈল অথবা সূর্যমুখি তেল দিয়ে রান্না করে ভগবানকে উৎসর্গ করে আহার করতে পারেন। জিরা, ধনিয়া, আদা, তেজপত্র, লবন ও মরিচ ব্যবহার্য। আবার অন্যান্য আহার্য যেমন- দুধ, কলা, আপেল,কমলা, আঙ্গুর, আনারস, আখ, আমড়া, শশা, তরমুজ, বেল, নারিকেল, মিষ্টি আলু, বাদাম ও লেবুর শরবত ইত্যাদি ফল মূলাদি খেতে পারেন।
আরো পড়ুনঃ আপনার তারুণ্যকে ধরে রাখুন সহজ কিছু উপায়ে
একাদশীতে নিষিদ্ধ খাদ্যশস্য :
★ ধান জাতীয় -
চাল,মুড়ি,চিড়া,খই, শ্যামাচাল,কাউন ইত্যাদি।
★ গম জাতীয় -
আটা,ময়দা,সুজি,পউরুটি,হরলিক্স,বিস্কুট ইত্যাদি।
★যব/ভূট্টা জাতীয় -
ছাতু,ভুট্টার খই ইত্যাদি।
★ ডাল জাতীয় -
সব ধরনের ডাল।
★ সবজি জাতীয় -
বরবটি, শিম,মটরশুঁটি, বেগুন,টমেটো, গাজর,মূলা ইত্যাদি।
★ তৈল জাতীয় -
সরিষা তেল,সয়াবিন তেল,তিল তেল ইত্যাদি।
উপরোক্ত পঞ্চরবি শস্যের যে কোন একটি একাদশীতে গ্রহণ করলে ব্রত ভঙ্গ হবে। উল্লেখ্য যারা সাত্ত্বিক আহারী নন এবং চা, বিড়ি/সিগারেট, পান, কফি ইত্যাদি নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেন একাদশী ব্রত পালনের সময় ঐগুলি গ্রহণ না করাই উত্তম।
একাদশী করলে যে কেবলমাত্র নিজের জীবনের সদগতি হবে তা নয় নিজের প্রয়াত পিতা/মাতা নরকবাসী হলে তারাও নরক থেকে উদ্ধার পাবে। যদি কেউ কোন বিধি নিষেধ পালন ছাড়া উদ্দেশ্যহীন ভাবেও একাদশী থাকে তবে ঐ ব্যক্তির একাদশীর সম্পূর্ণ ফল পাবে। একাদশীতে অন্ন ভোজন করলে এবং অন্যকে করালেও নরকগতি হবে। পঞ্জিকাতে একাদশী পারণের যে সময় দেওয়া থাকে সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে নিবেদন করে প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা বিধেয়। নতুবা একাদশীর কোন ফল লাভ হয় না।
আরো পড়ুনঃ জেনে নিন ফেসবুক রিলস কি এবং ফেসবুক রিলস থেকে ইনকামের সহজ কিছু পন্থা
পারণের সময়সূচী :
১৭ ই আগস্ট রোজ শনিবার সকাল ৫.৪১ মিনিট হতে ৮.৩৭ মিনিটের মধ্যে।
পারণ মন্ত্র :
একাদশ্যাং নিরাহারো ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভাব।।
এই মন্ত্র পাঠ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পারণ করতে হয়।
প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, আশা করি আপনারা সবাই ভগবান শ্রী হরির কৃপা পেতে নিষ্ঠা ও ভক্তির সাথে পবিত্রারোপণী একাদশী ব্রত পালন করবেন। ভগবানের কৃপায় সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। সবাইকে ধন্যবাদ। রাধে রাধে 🙏