শয়ন একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য ও পারণের সময় সূচি
হরে কৃষ্ণ বন্ধুরা 🙏সবাইকে আমার নমস্কার। আশা করি পরমেশ্বর কৃপায় সবাই ভালো আছেন। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী শয়ন নামে খ্যাত। আগামী ১৭ ই জুলাই রোজ বুধবার আমাদের নিষ্ঠা ও ভক্তির সাথে পালন করতে হবে এই শয়ন একাদশী ব্রত। যে ব্যক্তি এই প্রকার পবিত্র পাপনাশক এবং সকল অভিষ্ট প্রদাতা একাদশী ব্রত না করে তাকে নরকামী হতে হয়। তাই সকল পাপ বিনাশের জন্য এই ব্রত পালন করা আমাদের একান্ত আবশ্যক। বন্ধুরা আজ আমরা আপনাদের জানাবো অতি পবিত্র শয়ন একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য,একাদশী ব্রত পালনের নিয়মাবলী, একাদশীতে নিষিদ্ধ খাদ্যশস্য,পরের দিন পারণের সময়সূচী ও পারণের মন্ত্র।
বন্ধুরা, আমাদের একাদশী ব্রত পালনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নিরন্তন ভগবানকে স্মরণ করা। এই ব্রত পালনে যে ফল লাভ হয় তা অশ্বমেধ,রাজসূয় ও বাজপেয় যজ্ঞ দ্বারা হয় না। এই দিন ভাগবত শ্রবণে পৃথিবী দানের ফল লাভ হয়।
শয়ন একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য :
মহারাজ যুধিষ্ঠির বললেন- ‘হে কৃষ্ণ! আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম কি? এর মহিমাই বা কি ? তা আমাকে কৃপা করে বলুন।'
শ্রীকৃষ্ণ বলেলেন, ব্রহ্মা এই একাদশী সম্পর্কে দেবর্ষি নারদকে যা বললেন। আমি সেই আশ্চর্যজনক কথা আপনাকে বলছি। শ্রীব্রহ্মা বললেন হে নারদ!। এ সংসারে একাদশীর মতো পবিত্র আর কোন
ব্রত নেই। সকল পাপ বিনাশের জন্য এই বিষ্ণুব্রত পালন করা একান্ত আবশ্যক। যে ব্যাক্তি এই প্রকার পবিত্র পাপনাশক এবং সকল অভিষ্ট প্রদাতা একাদশী ব্রত না করে তাকে নরকগামী হতে হয়।
আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের এই একাদশী ‘শয়নী নামে বিখ্যাত। শ্রী ভগবান ঋষিকেশের জন্য এই ব্রত পালন করতে হয়। এই ব্রতের সমন্ধে একমঙ্গলময় পৌরণিক কাহিনী আছে। আমি এখন তা বলছি।
বহু বছর পূর্বে সূর্যবংশে মান্ধাতা নামে একজন রাজর্ষি ছিলেন। তিনি ছিলেন সত্যপ্রতিজ্ঞ এবং প্রতাপশালী চক্রবর্তী রাজা। প্রজাদেরকে তিনি নিজের সন্তানের মতো পালন করতেন। সেই রাজ্যে কোন রকম, দুঃখ, রোগ-ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ, আতঙ্ক খাদ্যাভাব অথবা কোন অন্যায় আচরন ছিল না। এইভাবে বহুদিন অতিবাহিত হলো। কিন্তু একসময় হঠাৎ দৈবদুর্বিপাকে ক্রমাগত তিনবছর সে রাজ্যে কোন বৃষ্টি হয়নি। দুর্ভিক্ষের ফলে সেখানে দেবতেদের উদ্দেশ্যে দানমন্ত্রের 'স্বাহা' 'স্বধা' ইত্যাদি শব্দও বন্ধ হয়ে গেল। এমনকি বেদপাঠও ক্রমশ বন্ধ হল।
আরো পড়ুনঃ ChatGPT কি এবং এর ব্যবহারের সুবিধা জেনে নিন
তখন প্রজারা রাজার কাছে এসে বলতে লাগল মহারাজ দয়া করে আমাদের কথা শুনুন। শাস্ত্রে জলকে নার বলা হয় আর সেই জলে ভগবানের অয়ন অর্থাৎ নিবাস। তাই ভগবানের এক নাম নারায়ণ। মেঘরূপে ভগবান বিষ্ণূ সর্বত্র বারি বর্ষণ করেন। সেই বৃষ্টি থেকে অন্ন এবং অন্ন খেয়ে প্রজাগণ জীবন ধারণ করেন। এখন সেই অন্নের অভাবে প্রজারা ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। অতএব হে মহারাজ আপনি এমন কোন উপায় অবলম্বন করুন যাতে আপনার রাজ্যের শান্তি এবং কল্যাণ সাধন হয়।
রাজা মান্ধাতা বললেন-তোমরা ঠিকই বলেছ। অন্ন থেকে প্রজার উদ্ভব। অন্ন থেকেই প্রজার পালন। তাই অন্নের অভাবে প্রজারা বিনষ্ট হয়। আবার রাজার দোষেও রাজ্য নষ্ট হয়। আমি নিজের বুদ্ধিতে আমার নিজের কোন দোষ খুঁজে পাচ্ছি না। তবুও প্রজাদের কল্যাণের জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব।
তারপর রাজা ব্রহ্মাকে প্রনাম করে সৈন্যসহ বনে গমন করলেন। সেখানে প্রধান প্রধান ঋষিদের আশ্রমে ভ্রমন করলেন। এভাবে তিনি ব্রহ্মারপুত্র মহাতেজস্বী অঙ্গিরা ঋষিরসাক্ষাৎ লাভ করলেন। তাকে দর্শনমাত্রই রাজা মাহানন্দে ঋষির চরন বন্দনা করলেন। মুনিবর তাকে আর্শীর্বাদ ও কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। রাজা তখন তার বনে আগমনের কারন সবিস্তারে ঋষির কাছে জানালেন।
ঋষি অঙ্গিরা কিছু সময় ধ্যানস্থ থাকার পর বলতে লাগলেন- ‘হে রাজন! এটি সত্যযুগ। এই যুগে সকললোক বেদ পরায়ন এবং ব্রাহ্মন ছাড়া অন্য তপস্যা করে না। এই নিয়ম থাকা সত্তেও এক শূদ্র এ রাজ্যে তপস্যা করছে। তার এই অকার্যের জন্যই রাজ্যের এই দুর্দশা। তাকে হত্যা করলেই সকল দোষ দূর হবে।
রাজা বললেন- হে মুনিবর! তপস্যাকারী নিরপরাধ ব্যক্তিকে আমি কিভাবে বধ করব? আমার পক্ষে সহজসাধ্য অন্য কোন উপায় থাকলে আপনি দয়া করে আমাকে বলুন।
তদুত্তরে মহর্ষি অঙ্গিরা বললেন- আপনি আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের শয়নী নামে প্রসিদ্ধা একাদশী ব্রত পালন করুন। এই ব্রতের প্রভাবে নিশ্চয়ই রাজ্যে বৃষ্টি হবে। এই একাদশী সর্বসিদ্ধি দাত্রী এবং সর্ব উপদ্রব নাশকারিনী। হে রাজন- প্রজা ও পরিবারবর্গ সহ আপনি এইব্রত পালন করুন।
মুনিবরের কথা শুনে রাজা নিজের প্রাসাদে ফিরে গেলেন। আষাঢ় মাস উপস্থিত হলে রাজ্যের সকল প্রজা রাজার সাথে এই একাদশী ব্রতের অনুষ্ঠান করলেন। ব্রত প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলো কিছুকালের মধ্যেই অন্নাভাব দূর হল। ভগবান হৃষিকেশের কৃপায় প্রজাগন সুখী হল।
এ কারণে সুখ ও মুক্তি প্রাদানকারী এই উত্তম ব্রত পালন করা সকলেরই অবশ্য কর্তব্য । ভবিষোত্তরপুরানে যুধিষ্ঠির–শ্রীকৃষ্ণ তথা নারদ-ব্রহ্মা সংবাদ রূপে এই মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে।
আরো পড়ুনঃ আপনার ফেসবুক একাউন্ট নিরাপদে রাখতে এই ৬ টি উপায় অবশ্যই মেনে চলুন
একাদশী ব্রত পালনের নিয়মাবলী :
১। সমর্থ পক্ষে দশমীতে একাহার, একাদশীতে নিরাহার ও দ্বাদশীতে একাহার করিবেন।
২। তা হতেও অসমর্থপক্ষে শুধুমাত্র একাদশীতে অনাহার।
৩। যদি উহাতেও অসমর্থ হন একাদশীতে পঞ্চ রবিশষ্য বর্জন করতঃ ফল মূলাদি অনুকল্প গ্রহণের বিধান রহিয়াছে। সমর্থ পক্ষে রাত্রি জাগরণের বিধি আছে।
গৌড়ীয় ধারায় বা মহান আচার্যবৃন্দের অনুমোদিত পঞ্জিকায় যে সমস্ত একাদশী নির্জলা (জল ব্যতীত) থেকে পালনের নির্দেশ প্রদান করেছেন। সেগুলি করলে সর্বোত্তম হয়। নিরন্তর কৃষ্ণভাবনায় থেকে নিরাহার থাকতে অপারগ হলে নির্জলাসহ অন্যান্য একাদশীতে কিছু সবজি ফল মূলাদি গ্রহণ করতে পারেন।
যেমন-গোল, আলু, মিষ্টি আলু ও চাল কুমড়া, পেঁপে, টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি সবজি ঘি, বাদাম তৈল অথবা সূর্যমুখি তেল দিয়ে রান্না করে ভগবানকে উৎসর্গ করে আহার করতে পারেন। জিরা, ধনিয়া, আদা, তেজপত্র, লবন ও মরিচ ব্যবহার্য। আবার অন্যান্য আহার্য যেমন- দুধ, কলা, আপেল,কমলা, আঙ্গুর, আনারস, আখ, আমড়া, শশা, তরমুজ, বেল, নারিকেল, মিষ্টি আলু, বাদাম ও লেবুর শরবত ইত্যাদি ফল মূলাদি খেতে পারেন।
আরো পড়ুনঃ অসাধারণ কবিতা পড়ুন একজন সাধারন কবির
একাদশীতে নিষিদ্ধ খাদ্যশস্য :
★ ধান জাতীয় -
চাল,মুড়ি,চিড়া,খই, শ্যামাচাল,কাউন ইত্যাদি।
★ গম জাতীয় -
আটা,ময়দা,সুজি,পউরুটি,হরলিক্স,বিস্কুট ইত্যাদি।
★যব/ভূট্টা জাতীয় -
ছাতু,ভুট্টার খই ইত্যাদি।
★ ডাল জাতীয় -
সব ধরনের ডাল।
★ সবজি জাতীয় -
বরবটি, শিম,মটরশুঁটি, বেগুন,টমেটো, গাজর,মূলা ইত্যাদি।
★ তৈল জাতীয় -
সরিষা তেল,সয়াবিন তেল,তিল তেল ইত্যাদি।
উপরোক্ত পঞ্চরবি শস্যের যে কোন একটি একাদশীতে গ্রহণ করলে ব্রত ভঙ্গ হবে। উল্লেখ্য যারা সাত্ত্বিক আহারী নন এবং চা, বিড়ি/সিগারেট, পান, কফি ইত্যাদি নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেন একাদশী ব্রত পালনের সময় ঐগুলি গ্রহণ না করাই উত্তম।
একাদশী করলে যে কেবলমাত্র নিজের জীবনের সদগতি হবে তা নয় নিজের প্রয়াত পিতা/মাতা নরকবাসী হলে তারাও নরক থেকে উদ্ধার পাবে। যদি কেউ কোন বিধি নিষেধ পালন ছাড়া উদ্দেশ্যহীন ভাবেও একাদশী থাকে তবে ঐ ব্যক্তির একাদশীর সম্পূর্ণ ফল পাবে। একাদশীতে অন্ন ভোজন করলে এবং অন্যকে করালেও নরকগতি হবে। পঞ্জিকাতে একাদশী পারণের যে সময় দেওয়া থাকে সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে নিবেদন করে প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা বিধেয়। নতুবা একাদশীর কোন ফল লাভ হয় না।
আরো পড়ুনঃ এই গরমে ডাবের পানির জাদুকরি গুনাগুন জেনে নিন
পারণের সময়সূচী :
১৮ ই জুলাই রোজ বৃহস্পতিবার সকাল ৫.২৭ মিনিট হতে ৯.৪৩ মিনিটের মধ্যে।
পারণ মন্ত্র :
একাদশ্যাং নিরাহারো ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভাব।।
এই মন্ত্র পাঠ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পারণ করতে হয়।
প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, আশা করি আপনারা সবাই ভগবান শ্রী হরির কৃপা পেতে নিষ্ঠা ও ভক্তির সাথে শয়ন একাদশী ব্রত পালন করবেন। ভগবানের কৃপায় সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। সবাইকে ধন্যবাদ। রাধে রাধে 🙏