যোগিনী একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য এবং পারনের সময়সূচী ও মন্ত্র

হরে কৃষ্ণ 🙏বন্ধুরা, সবাইকে আমার নমস্কার। আশা করি সবাই ভালো আছে। আমাদের সনাতন ধর্ম অনুসারে বছরে ২৪ টি একাদশী ব্রত পালিত হয়। আর প্রতিটি একাদশী রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম ও মাহাত্ম্য। আষাঢ়  মাসের কৃষ্ণপক্ষীয়া একাদশী 'যোগিনি' নামে প্রসিদ্ধ। এই একাদশী সকল পাপবিনাশিনী ও মুক্তি প্রদায়িনী। নিষ্ঠা ও ভক্তির সাথে এই ব্রত পালন করলে ৮৮ হাজার ব্রাহ্মণ ভোজনের ফল লাভ হয়। আগামী ২ রা জুলাই রোজ মঙ্গলবার আমাদের পালন করতে হবে এই যোগিনি একাদশী ব্রত। বন্ধুরা আজ আমরা আপনাদের জানাবো অতি পবিত্র 'যোগিনি' একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য,একাদশী ব্রত পালনের নিয়মাবলী, একাদশীতে নিষিদ্ধ খাদ্যশস্য,পরের দিন পারণের সময়সূচী ও পারণের মন্ত্র।

যোগিনী একাদশী

বন্ধুরা, আমাদের একাদশী ব্রত পালনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নিরন্তন ভগবানকে স্মরণ করা। এই ব্রত পালনে যে ফল লাভ হয় তা অশ্বমেধ,রাজসূয় ও বাজপেয় যজ্ঞ দ্বারা হয় না। এই দিন ভাগবত শ্রবণে পৃথিবী দানের ফল লাভ হয়।

যোগিনী একাদশীর মাহাত্ম্য :

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য যুধিষ্ঠির- শ্রীকৃষ্ণ সংবাদে বর্ণিত আছে। যুধিষ্ঠির বললেন- হে বাসুদেব! আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষীয়া একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য কৃপাপূর্বক আমার কাছে বর্ণনা করুন।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন--হে মহারাজ! সকল পাপবিনাশিনী ও মুক্তিপ্রদ এই উত্তম ব্রতের কথা বলছি, আপনি শ্রবণ করুন। আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষীয়া একাদশী 'যোগিনী' নামে পরিচিত। মহাপাপ বিনাশকারী এই তিথি ভবসাগরে পতিত মানুষের উদ্ধারলাভের একমাত্র নৌকাস্বরূপ। ব্রত পালনকারীদের পক্ষে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রত বলে প্রসিদ্ধ। এই প্রসঙ্গে আপনাকে একটি পবিত্র পৌরাণিক কাহিনী বলছি।

আরো পড়ুনঃ হার্টকে সুস্থ রাখতে এই ৭ টি খাবার থেকে দূরে থাকুন-

অলকা নগরে শিবভক্ত পরায়ণ কুবের নামে এক রাজা ছিল। তিনি প্রত্যহ শিবপূজা করতেন। তার হেমমালী নামে একজন মালী ছিল। প্রতিদিন শিব পূজার জন্য মানস সরোবর থেকে সে ফুল তুলে যক্ষরাজ কুবেরকে দিত। বিশালাক্ষী নামে হেমমালীর এক পরমা রূপবতী পত্নী ছিল। সে তার সুন্দরী পত্নীর প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ছিল। একদিন সে তার স্ত্রীর প্রতি কামাসক্ত হয়ে পড়ল। রাজভবনে যাওয়ার কথাও ভুলে গেল। বেলা দুই প্রহর অতীত হল। অর্চনের সময় চলে যাচ্ছে দেখে রাজা ক্রুদ্ধ হলেন। মালীর বিলম্বের কারণ অনুসন্ধানে এক দূত প্রেরণ করলেন।

দূত এসে রাজাকে বলল -- 'সে গৃহে স্ত্রীর সাথে আনন্দে মত্ত।' দূতের কথা শুনে কুবের রেগে তখনই মালীকে তার সামনে হাজির করতে আদেশ দিল। এদিকে মালী পূজার সময় অতিবাহিত হয়েছে বুঝতে পেরে অত্যন্ত ভয় পেল। তাই স্নান না করেই সে রাজার কাছে উপস্থিত হল।

তাকে দেখামাত্র রাজা ক্রোধবশে চোখ রাঙিয়ে বললেন--রে পাপিষ্ঠ, দুরাচার! তুই দেবপূজার পুষ্প আনতে অবজ্ঞা করেছিস তাই আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি তুই শ্বেতকুষ্ঠগ্রস্ত হয়ে যা এবং তোর প্রিয়তমা ভার্যার সাথে তোর চিরবিয়োগ সংগঠিত হোক। রে নীচ, তুই এখনি এই স্থান থেকে ভ্রষ্ট হয়ে অধোগতি লাভ কর।

কুবেরের এই অভিশাপে হেমমালী তার পত্নীর সাথে স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে দীর্ঘকাল যাবৎ কুষ্ঠরোগ ভোগ করতে লাগল। রোগের যন্ত্রণায় দিন অথবা রাত্রে কখনই সে সুখ পেত না। এভাবে শীত গ্রীষ্মে প্রচন্ড বেদনায় বহু কষ্টে সে জীবন যাপন করতে লাগল। কিন্তু দীর্ঘদিন মহাদেবের অর্চনের ফুল সংগ্রহের সুকৃতির ফলে সে শাপগ্রস্ত হয়েও বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ শিবের বিস্মরণ কখনও হয়নি।

একদিন হেমমালী ভ্রমণ করতে করতে হিমালয়ে শ্রী মার্কণ্ডেয় ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হল। কুষ্ঠরোগে পীড়িত সপত্নী হেমমালীকে দর্শন করে স্ত্রী মার্কণ্ডেয় তাকে জিজ্ঞাসা করলেন--তুমি কার অভিশাপে এই রকম নিন্দনীয় কুষ্ঠরোগগ্রস্ত হয়েছ?"

আরো পড়ুনঃজানেন কি প্রতিদিন বাদাম খেলে কি কি উপকার পাওয়া যায়

সে উত্তর দিল--'হে মুনিবর! রাজা ধনকুবেরের আমি ভৃত্য ছিলাম। আমার নাম হেমমালী। আমি প্রত্যহ মানস সরোবর থেকে ফুল তুলে শিব পূজার জন্য রাজাকে দিতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে একদিন স্ত্রীর মনোরঞ্জন হেতু কামাসক্ত হওয়ায় সেই ফুল দিতে বিলম্ব হয়। রাজার অভিশাপে এই রকম দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছি। পরোপকারই সাধুগণের স্বাভাবিক কর্ম। হে ঋষিশ্রেষ্ঠ! আমি অত্যন্ত অপরাধী। কৃপা করে আমার প্রতি প্রসন্ন হন।

তখন দয়ার্দ্র চিত্ত মার্কণ্ডেয় মুনি বললেন- হে মালী! তোমার মঙ্গলের জন্য শুভফল প্রদানকারী এক ব্রতের উপদেশ করছি। তুমি আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষের 'যোগিনী' নামক একাদশী পালন কর। এই ব্রতের পুণ্য প্রভাবে তুমি অবশ্যই কুষ্ঠব্যাধি থেকে যুক্ত হবে।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন--ঋষির উপদেশ শ্রবণ করে হেমমালী তাকে প্রণাম জানাল। পরে অত্যন্ত আনন্দে ঋষির আদেশ মতো নিষ্ঠার সঙ্গে যোগিনী একাদশী ব্রত পালন করল। এই ভাবে হেমমালী সমস্ত রোগ থেকে মুক্ত হল ও পত্নীসহ সুখে জীবন যাপন করতে লাগল।

হে মহারাজ যুধিষ্ঠির! আমি আপনার কাছে এই ব্রত উপবাসের মহিমা কীর্তন করলাম। এই ব্রত পালনে অষ্টাশি হাজার ব্রাহ্মণকে ভোজন করানোর ফল লাভ হয়। যে ব্যক্তি এই মহাপাপ বিনাশকারী ও পুণ্য ফল প্রদায়ী যোগিনী একাদশীর কথা পাঠ ও শ্রবণ করে সে অচিরেই সর্বপাপ থেকে মুক্ত হবে।

একাদশী ব্রত পালনের নিয়মাবলী :

১। সমর্থ পক্ষে দশমীতে একাহার, একাদশীতে নিরাহার ও দ্বাদশীতে একাহার করিবেন।

২। তা হতেও অসমর্থপক্ষে শুধুমাত্র একাদশীতে অনাহার।

৩। যদি উহাতেও অসমর্থ হন একাদশীতে পঞ্চ রবিশষ্য বর্জন করতঃ ফল মূলাদি অনুকল্প গ্রহণের বিধান রহিয়াছে। সমর্থ পক্ষে রাত্রি জাগরণের বিধি আছে।

গৌড়ীয় ধারায় বা মহান আচার্যবৃন্দের অনুমোদিত পঞ্জিকায় যে সমস্ত একাদশী নির্জলা (জল ব্যতীত) থেকে পালনের নির্দেশ প্রদান করেছেন। সেগুলি করলে সর্বোত্তম হয়। নিরন্তর কৃষ্ণভাবনায় থেকে নিরাহার থাকতে অপারগ হলে নির্জলাসহ অন্যান্য একাদশীতে কিছু সবজি ফল মূলাদি গ্রহণ করতে পারেন।

যেমন-গোল, আলু, মিষ্টি আলু ও চাল কুমড়া, পেঁপে, টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি সবজি ঘি, বাদাম তৈল অথবা সূর্যমুখি তেল দিয়ে রান্না করে ভগবানকে উৎসর্গ করে আহার করতে পারেন। জিরা, ধনিয়া, আদা, তেজপত্র, লবন ও মরিচ ব্যবহার্য। আবার অন্যান্য আহার্য যেমন- দুধ, কলা, আপেল,কমলা, আঙ্গুর, আনারস, আখ, আমড়া, শশা, তরমুজ, বেল, নারিকেল, মিষ্টি আলু, বাদাম ও লেবুর শরবত ইত্যাদি ফল মূলাদি খেতে পারেন।

আরো পড়ুনঃএই গরমে ডাবের পানির জাদুকরি গুনাগুন জেনে নিন

একাদশীতে নিষিদ্ধ খাদ্যশস্য :

★ ধান জাতীয় - 

চাল,মুড়ি,চিড়া,খই, শ্যামাচাল,কাউন ইত্যাদি। 

★ গম জাতীয় -  

আটা,ময়দা,সুজি,পউরুটি,হরলিক্স,বিস্কুট ইত্যাদি। 

★যব/ভূট্টা জাতীয় -

ছাতু,ভুট্টার খই ইত্যাদি। 

★ ডাল জাতীয় -

সব ধরনের ডাল। 

★ সবজি জাতীয় - 

বরবটি, শিম,মটরশুঁটি, বেগুন,টমেটো, গাজর,মূলা ইত্যাদি। 

★ তৈল জাতীয় - 

সরিষা তেল,সয়াবিন তেল,তিল তেল ইত্যাদি।

উপরোক্ত পঞ্চরবি শস্যের যে কোন একটি একাদশীতে গ্রহণ করলে ব্রত ভঙ্গ হবে। উল্লেখ্য যারা সাত্ত্বিক আহারী নন এবং চা, বিড়ি/সিগারেট, পান, কফি ইত্যাদি নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেন একাদশী ব্রত পালনের সময় ঐগুলি গ্রহণ না করাই উত্তম। 

একাদশী করলে যে কেবলমাত্র নিজের জীবনের সদগতি হবে তা নয় নিজের প্রয়াত পিতা/মাতা নরকবাসী হলে তারাও নরক থেকে উদ্ধার পাবে। যদি কেউ কোন বিধি নিষেধ পালন ছাড়া উদ্দেশ্যহীন ভাবেও একাদশী থাকে তবে ঐ ব্যক্তির একাদশীর সম্পূর্ণ ফল পাবে। একাদশীতে অন্ন ভোজন করলে এবং অন্যকে করালেও নরকগতি হবে। পঞ্জিকাতে একাদশী পারণের যে সময় দেওয়া থাকে সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে নিবেদন করে প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা বিধেয়। নতুবা একাদশীর কোন ফল লাভ হয় না।

আরো পড়ুনঃধনী হতে চাইলে এই ১০ টি উপায় অবলম্বন করুন

পারণের সময়সূচী :

৩ রা জুলাই রোজ বুধবার  সকাল ৫.২১ মিনিট হতে ৭.৪২ মিনিটের মধ্যে। 


পারণ মন্ত্র :

একাদশ্যাং নিরাহারো ব্রতেনানেন কেশব। 

প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভাব।। 

এই মন্ত্র পাঠ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পারণ করতে হয়।  

প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, আশা করি আপনারা সবাই ভগবান শ্রী হরির কৃপা পেতে নিষ্ঠা ও ভক্তির সাথে যোগিনি একাদশী ব্রত পালন করবেন। ভগবানের কৃপায় সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। সবাইকে ধন্যবাদ। রাধে রাধে 🙏



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url