মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য পারণের সময়সূচি ও পারণ মন্ত্র -
হরে কৃষ্ণ 🙏বন্ধুরা, সবাইকে আমার নমস্কার। আশা করি সবাই ভালো আছে। আমাদের সনাতন ধর্ম অনুসারে বছরে ২৪ টি একাদশী ব্রত পালিত হয়। আর প্রতিটি একাদশী রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম ও মাহাত্ম্য। একাদশী তিথি হচ্ছে ভগবানের প্রিয় তিথি। এই তিথির আরেক নাম হরিবাসর তিথি। আগামী ১৯ শে মে রোজ রবিবার পালিত হবে মোহিনী একাদশী ব্রত। বন্ধুরা আজ আমি আপনাদের জানাবো এই অতি পবিত্র মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য, একাদশীতে নিষিদ্ধ খাদ্যশস্য, পরের দিন পারণের সময়সূচি ও পারণ মন্ত্র -
বন্ধুরা, আমাদের একাদশী ব্রত পালনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নিরন্তন ভগবানকে স্মরণ করা। এই ব্রত পালনে যে ফল লাভ হয় তা অশ্বমেধ,রাজসূয় ও বাজপেয় যজ্ঞ দ্বারা হয় না। এই দিন ভাগবত শ্রবণে পৃথিবী দানের ফল লাভ হয়। আসুন জেনে নেই অতি পবিত্র মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য -
মোহিনী একাদশী মাহাত্ম্য :
কুর্মপুরাণে বৈশাখ শুক্লপক্ষের ‘মোহিনী’ একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। মহারাজ যুধিষ্ঠির বললেন- ‘হে জনার্দন! বৈশাখ শুক্লপক্ষীয়া একাদশীর কি নাম, কি ফল, কি বিধি-এসকল কথা আমার নিকট বর্ণনা করুন।’উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন-হে ধর্মপুত্র! আপনি আমাকে যে প্রশ্ন করেছেন পূর্বে শ্রীরামচন্দ্রও বশিষ্ঠের কাছে এই একই প্রশ্ন করেছিলেন।
তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন- হে মুনিবর! আমি জনকনন্দিনী সীতার বিরহজনীত কারণে বহু দু:খ পাচ্ছি। তাই একটি উত্তম ব্রতের কথা আমাকে বলুন। যার দ্বারা সর্বপাপ ক্ষয় হয় ও সর্বদু:খ বিনষ্ট হয়। এই কথা শুনে বশিষ্ঠদেব বললেন-হে রামচন্দ্র! তুমি উত্তম প্রশ্ন করেছ। যদিও তোমার নামগ্রহণেই মানুষ পবিত্র হয়ে থাকে। তবুও লোকের মঙ্গলের জন্য তোমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ ও পরম পবিত্র একটি ব্রতের কথা বলছি। বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষীয়া একাদশী ‘মোহিনী’ নামে প্রসিদ্ধা। এই ব্রত প্রভাবে মানুষের সকল পাপ, দু:খ ও মোহজাল অচিরেই বিনষ্ট হয়। তাই মানুষের উচিত সকল পাপক্ষয়কারী ও সর্বদু:খবিনাশী এই একাদশী ব্রত পালন করা। একাগ্রচিত্তে তার মহিমা তুমি শ্রবণ কর। এই কথা শ্রবণমাত্রেই সমস্ত পাপ বিনষ্ট হয়।
পবিত্র সরস্বতী নদীর তীরে ভদ্রাবতী নামে এক সুশোভনা নগরী ছিল। চন্দ্রবংশজাত ধৃতিমান নামে এক রাজা সেখানে রাজত্ব করতেন। সেই নগরীতেই ধনপাল নামে এক বৈশ্য বাস করতেন। তিনি ছিলেন পুণ্যকর্মা ও সমৃদ্ধশালী ব্যক্তি। তিনি নলকূপ, জলাশয়, উদ্যান, মঠ ও গৃহ ইত্যাদি নির্মাণ করে দিতেন। তিনি ছিলেন বিষ্ণুভক্তি পরায়ণ ও শান্ত প্রকৃতির মানুষ।
সুমনা, দ্যুতিমান, মেধাবী, সুকৃতি ও ধৃষ্টবুদ্ধি নামে তার পাঁচজন পুত্র ছিল। পঞ্চম পুত্র ধৃষ্টবুদ্ধি ছিল অতি দুরাচারী। সে সর্বদা পাপকার্যে লিপ্ত থাকত। পরস্ত্রী সঙ্গী, বেশ্যাসক্ত, লম্পট ও দ্যুতক্রীড়া প্রভৃতি পাপে সে অত্যন্ত আসক্ত ছিল। দেবতা, ব্রাহ্মণ ও পিতামাতার সেবায় তার একেবারেই মতি ছিল না। সে অন্যায়কার্যে রত, দুষ্টস্বভাব ও পিতৃধন ক্ষয়কারক ছিল। সবসময় সে অভক্ষ ভক্ষণ ও সুরাপানে মত্ত থাকত।
পিতা ধনপাল একদিন পথ চলছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন ধৃষ্টবুদ্ধি এক বেশ্যার গলায় হাত রেখে নি:সঙ্কোচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার নির্লজ্জ পুত্রকে এভাবে চৌরাস্তায় ভ্রমণ করতে দেখে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। এই কুস্বভাব দর্শনে ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি তাকে গৃহ থেকে বার করে দিলেন। তার আত্মীয়-স্বজনও তাকে পরিত্যাগ করল। সে তখন নিজের অলংকারাদি বিক্রি করে জীবন অতিবাহিত করত। কিছুদিন এইভাবে চলার পর অর্থাভাব দেখা দিল। ধনহীন দেখে সেই বেশ্যাগণও তাকে পরিত্যাগ করল।
অন্নবস্ত্রহীন ধৃষ্টবুদ্ধি ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়ল। অবশেষে নিজের গ্রামে সে চুরি করতে শুরু করল। একদিন রাজপ্রহরী তাকে ধরে বন্দী করল। কিন্তু পিতার সন্মানার্থে তাকে মুক্ত করে দিল। এভাবে বারকয়েক সে ধরা পড়ল ও ছাড়া পেল। কিন্তু তবুও সে চুরি করা বন্ধ করল না। তখন রাজা তাকে কারাগারে বদ্ধ করে রাখলেন। বিচারে সে কষাঘাত দন্ডভোগ করল। কারাভোগের পর অনন্য উপায় ধৃষ্টবুদ্ধি বনে প্রবেশ করল। সেখানে সে পশুপাখি বধ করে তাদের মাংস ভক্ষণ করে অতি দু:খে পাপময় জীবন যাপন করতে লাগল।
দুষ্কর্মের ফলে কেউ কখনও সুখী হতে পারে না। তাই সেই ধৃষ্টবুদ্ধি দিবারাত্রি দু:খশোকে জর্জরিত হল। এভাবে অনেকদিন অতিবাহিত হল। কোন পুণ্যফলে সহসা একদিন সে কৌন্ডিন্য ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হল। বৈশাখ মাসে ঋষিবর গঙ্গাস্নান করে আশ্রমের দিকে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। শোককুল ধৃষ্টবুদ্ধি তার সম্মুখে উপস্থিত হল। ঘটনক্রমে ঋষির বস্ত্র হতে একবিন্দু জল তার গায়ে পড়ল। সেই জলস্পর্শে তার সমস্ত পাপ দূর হল। হঠাৎ তার শুভবুদ্ধির উদয় হল।
ঋষির সামনে সে কৃতাঞ্জলিপুটে প্রার্থণা করতে লাগল ‘হে ঋষিশ্রেষ্ঠ! যে পুণ্য প্রভাবে আমি এই ভীষণ দৃ:খযন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভ করতে পারি, তা কৃপাকরে আমাকে বলুন।’ ঋষিবর বললেন-‘বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষে মোহিনী নামে যে প্রসিদ্ধ একাদশী আছে, তুমি সেই ব্রত পালন কর। এই ব্রতের ফলে মানুষের বহু জন্মার্জিত পর্বত পরিমাণ পাপরাশিও ক্ষয় হয়ে থাকে।
আরো পড়ুনঃ এই গরমে ডাবের পানির জাদুকরি গুনাগুন
মহামুনি বশিষ্ঠ বললেন-কৌন্ডিন্য ঋষির উপদেশ শ্রবণ করে প্রসন্ন চিত্তে ধৃষ্টবুদ্ধি সেই ব্রত পালন করল।
হে মহারাজ রামচন্দ্র! এই ব্রত পালনে সে নিষ্পাপ হল। দিব্যদেহ লাভ করল। অবশেষে গরুড়ে আরোহন করে সকল প্রকার উপদ্রবহীন বৈকুন্ঠধামে গমন করল। হে রাজন, ত্রিলোকে মোহিনী ব্রত থেকে আর শ্রেষ্ঠ ব্রত নেই। যজ্ঞ, তীর্থস্থান, দান ইত্যাদি কোন পুণ্যকর্মই এই ব্রতের সমান নয়। এই ব্রত কথার শ্রবণ কীর্তনে সহস্র গোদানের ফল লাভ হয়।
একাদশীতে নিষিদ্ধ খাদ্যশস্য :
★ ধান জাতীয় -
চাল,মুড়ি,চিড়া,খই, শ্যামাচাল,কাউন ইত্যাদি।
★ গম জাতীয় -
আটা,ময়দা,সুজি,পউরুটি,হরলিক্স,বিস্কুট ইত্যাদি।
★যব/ভূট্টা জাতীয় -
ছাতু,ভুট্টার খই ইত্যাদি।
★ ডাল জাতীয় -
সব ধরনের ডাল।
★ সবজি জাতীয় -
বরবটি, শিম,মটরশুঁটি, বেগুন,টমেটো, গাজর,মূলা ইত্যাদি।
★ তৈল জাতীয় -
সরিষা তেল,সয়াবিন তেল,তিল তেল ইত্যাদি।
পারণের সময়সূচী :
২০ শে মে রোজ সোমবার সকাল ৫.২০ মিনিট হতে ৯.৩৪ মিনিটের মধ্যে।
পারণ মন্ত্র :
একাদশ্যাং নিরাহারো ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভাব।।
এই মন্ত্র পাঠ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পারণ করতে হয়।
প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, আশা করি আপনারা সবাই ভগবান শ্রী হরির কৃপা পেতে নিষ্ঠা ও ভক্তির সাথে মোহিনী একাদশী ব্রত পালন করবেন। ভগবানের কৃপায় সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। সবাইকে ধন্যবাদ। রাধে রাধে 🙏