লোককাহিনী - বেহুলা ও লক্ষিন্দরের বাসর ঘর
প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, আজ আমরা আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি একটি ভিন্নধর্মী প্রতিবেদন। আজ আমরা বাংলা লোককাহিনীর একটি পুরাণ কাহিনী আপনাদের সামনে তুলে ধরব। লোককাহিনী বা লোককথা হল বাংলা লোকসাহিত্যের একটি শাখা যা সাধারণত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মৌখিকভাবে কথা, কিসসা বা গপ নিয়ে গঠিত। বলা যায় যে, লোককাহিনী বংশানুক্রমিত ভাবে প্রাপ্ত সম্পদ। ইতিহাস, পুরাণ, বিভিন্ন ধর্মীয় ভাব আদর্শ, রূপকথা, লৌকিক ঘটনা ধারা অবলম্বনে লোককাহিনী বা লোককথা রচিত হয়। চলুন বন্ধুরা দেখিনি আজকের লোককাহিনী - বেহুলা ও লক্ষিন্দরের বাসর ঘর।
লোককাহিনী - বেহুলা ও লক্ষিন্দরের বাসর ঘর
চম্পাক নগরে চাঁদ সওদাগর নামে এক বণিক বাস করতেন। একবার তিনি মহাদেব কে
সন্তুষ্ট করে বরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, যদি চাঁদ সওদাগর পূজা দেন তাহলে ত্রিলোকে মনসার
পূজা প্রচলিত হবে। চাঁদ একে তো মনসা বিদ্বষী তাতে আবার ওঝা ধনন্তরি ছিলেন তার বন্ধু।
চাঁদ সওদাগর নিজেও মহা জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে ছিলেন। এ দ্বারা তিনি নিজে সর্প দৃষ্ট ব্যক্তিকে
নিরাময় করতে পারতেন। সুতরাং চাঁদ কিছুতেই মনসা পূজার সম্মত হলেন না। মনসা কৌশলে চাঁদের
মহা জ্ঞান পরীক্ষা করলেন । ওঝা ধনন্তরি কে নিপাতন করলেন। চাঁদের ছয় পুত্র লোক লষ্কর বিনাশ
করলেন। কিন্তু তারপরও চাঁদ মনসার নিকট নত হওয়া
তো দূরের কথা হেম তালের লাচ দ্বারা মনসাকে
তাড়িয়ে দিলেন এবং ঘৃণার সঙ্গে বললেন –
“ যে হাতে পূজেছি আমি দেব শূল পানি
সে হাতে পূজিব আমি বেভ খাকি কানী”
আরো পড়ুনঃ জেনে নিন ২০২৩ সালের দুর্গাপূজার সময় সূচী ও বিভিন্ন তথ্য
চাঁদ এই রূপে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা রইল বটে কিন্তু গৃহিণী সুনকার আর্তনাদে গৃহে তার মন টিকলো না। সবাই পাণ্ডিতকে ডেকে ভালো দিন দেখে ঢাক ঢোল বাজনা সাজিয়ে বানিজ্যার্থে সিংহলে রওনা দিলেন। যথাসময়ে চাঁদের ডিঙ্গা সিংহলে উপস্থিত হলে তিনি সিংহল রাজাকে নারীকেল উপঢৌকন দিলেন। কিন্তু মনসার চক্রান্তে সিংহল রাজা নারিকেলকে বিষফল মনে করে পরীক্ষার জন্য তিনকাড়িয়া নামক এক ক্রীতদাসকে তা ভক্ষণ করার আদেশ করেন। তখন তিনকাড়িয়া প্রাণ ভয়ে ভীত হয়ে বলে –
“সওয়া টাকার মানিলেক সত্য, নারায়নের পূজা
শিবের ধস্তয়ন মানে চন্ডী
সাগর
শুভ চুনীর গুয়ো মানে
পীরের ছাগর”
অবশেষে রাজা আদেশ অবহেলা করতে না পেরে ভীত চিত্তে নারিকেলের সুমিষ্ট জল
পান করতে লাগলো। সিংহল রাজা যখন দেখল যে তিনকাড়িয়া মরল না তখন চাঁদের সঙ্গে তিনি সৌহার্দ
স্থাপন করেন এবং উভয়ের মধ্যে নানা প্রকার দ্রব্যও বিনিময়ের ব্যবস্থা করেন।
“ সুকদা বদলে মূকুতা লয় পাঠ বদলে নেত
চট বদলে কম্বল লয় শব্দের বদলে শ্বেত”
আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী মায়েদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস
এই রূপে বহু পণ্য সংগ্রহ করে চাঁদ সওদাগর অবশেষে গৃহে ফিরে চললেন। চাঁদকে কিছুতেই খর্ব করতে না পেরে পদ্মাদেবী অবশেষে কালিদহ সাগরে মহা ঝড় সৃষ্টি করলেন এবং চাঁদের মধুকর ডিঙ্গা গুলি ডুবিয়ে দিলেন। চাঁদ অতি কষ্টে জীবন রক্ষা করে রিক্ত হস্তে গৃহে ফিরলেন।কিন্তু তিনি তবুও মনসার নিকট অবনত হলেন না।
এ সময়ে চাঁদের পরম রুপবান এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার নাম হল লক্ষিন্দর।
দৈবজ্ঞ গণনা করে বললেন যে, বাসর ঘরে লক্ষিন্দরের সর্পঘাতে মৃত্যু হবে।
লক্ষিন্দরের বিবাহের বয়স হল, তখন নিত্যান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাঁদ স্বীয়
পত্নীর অনুরোধে পুত্রের বিবাহ দিতে বাধ্য হলেন। সর্পঘাতের কোন প্রকার আশঙ্কা না থাকে
সেজন্য তিনি লৌহময় বাসর ঘর তৈরি করলেন। উজানী নগরে বাসো বানিয়ার অপরূপ সুন্দরী কন্যা
বেহুলার সঙ্গে লক্ষিন্দরের বিবাহ সুসম্পন্ন হল। কিন্তু চাঁদের সতর্কতা সত্বেও দৈবজ্ঞে
বাক্য নিষ্ফল হলো না। বাসরে বেহুলা সতী রাত্রি জেগে স্বামীকে পাহারা দিতে ছিলেন। কিন্তু
শেষ রাতে মনসার মায়ায় বেহুলা লক্ষিন্দর উভয়ের চোখের তন্দ্রার আবির্ভাব হয়। ফলে
সেই সুযোগে মনসার প্রিয় কাল নাগিনী সুতার আকার ধারণ করে পরিকল্পিত পথে একটি সাপ বাসর
ঘরে ঢোকে এবং লক্ষিন্দর কে নিহত করে।
লক্ষিন্দর মৃত্যুমুখে পতিত হলে বেহুলা জেগে ওঠে। তারপর করুণভারে বিলাপ করতে থাকেন। বেহুলার অস্পষ্ট ক্রন্দন ধ্বনি শ্রবণ করে সনকা রানী এসে দেখেন সর্বনাশ হয়েছে । তখন তিনি নিত্যান্ত অধীর হয়ে নববধূকে এই দুর্ঘটনার মূল কারণ জ্ঞানে নানা বাক্য তিরস্কার করতে লাগলেন। এদিকে চাঁদ সওদাগর প্রতিবেশীদের কে ডেকে শবদেহ দাহ করার আয়োজন করতে লাগলেন। কিন্তু বেহুলা শবদাহের কথা শুনে সদর্পে বললেন –
“যদি ঊষা হই সতী সাহসে জীয়াব পতি
ন্যায়ে জিনিব দেবের নগর”
আরো পড়ুনঃ একজন সাধারণ কবির অসাধারণ কবিতা
এই কথা বলে শশুরের নিকট থেকে স্বামীর শবদেহ ভিক্ষা নিয়ে কদলী গাছের ভেলাতে তুলে স্রোতের উজান দিকে ভেসে চললেন।পথে মনসা দেবী নানাভাবে বেহুলা কে পরীক্ষা করতে লাগলেন। ভেলা দাসী ঘাট পেরিয়ে গদার বাঁকে এসে উপনীত হলো।
অতি কষ্টে গোদার হাত থেকে এড়াতে না এড়াতেই বেহুলা এক বণিকের হস্তে নিপতিত
হলেন। কিন্তু পরিচয়ের পর বণিক যখন জানতে পারলেন যে বেহুলা তার ভগ্নি তখন তিনি লজ্জিত
হলেন এবং ভগ্নীকে ফিরে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু বেহুলা তা প্রত্যাখ্যান করে
আপন গতিতে চলতে লাগলেন।
ভেলা একসময় নিতাই ধোপানির ঘাটে এসে উপনীত হলো। এই স্থানে এসে বেহুলা দেখতে
পেলেন যে ধোপানি সোনার পাটের নিজ থেকে তার মৃত পুত্রকে বের করে বাসকের একখন্ড ডাল নিয়ে
নিরঞ্জনের মন্ত্র পড়ে তাকে পূর্ণ জীবিত করলেন। ধোপানির এই অলৌকিক ক্ষমতা দর্শন করে
বেহুলা তখন তার স্বামীর জীবন লাভের জন্য তার পদতলে পতিত হলেন।
নেতাই বেহুলার কাহিনী শ্রবণ করে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন এবং তাকে শিবের নিকট উপস্থিত হওয়ার জন্য উপদেশ দিলেন। যথা নিয়মে শিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বেহুলা দেবতাদের কে নিত্য দেখিয়ে খুশি করবেন। এখানে পদ্মার বিচার হলো। বিচারে পদ্মা দেবী দোষী হলেন। শিব লক্ষিন্দর কে পূর্ণ জীবিত করে দেবার জন্য পদ্মা কে আদেশ দিলেন। বেহুলা পদ্মাকে স্তব স্ত্রোতে সন্তুষ্ট করলেন।
আরো পড়ুনঃ বগুড়া জেলা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য সমূহ জানুন।
পদ্মা খুশি হয়ে লক্ষিন্দর কে জীবিত করে দিলেন। শুধু তাই নয়, বেহুলার অনুরোধে পদ্মা দেবী লক্ষিন্দরের হয় ভ্রাতা, ধনন্তরি ওঝা, সমাই পন্ডিত সবাইকে পূর্ণ জীবিত করলেন। তারপর নিমজ্জিত মধুকর ডিঙ্গা গুলিও উদ্ধার করে দিলেন। বেহুলা সন্তুষ্ট হয়ে শশুরের নিকট থেকে পূজা আদায়ের জন্য পদ্মা দেবীর নিকট অঙ্গীকারে আবদ্ধ হলেন। পদ্মা খুশি হয়ে তার সঙ্গে চম্পক নগরে যাত্রা করলেন। যথাসময়ে চৌদ্দ ডিঙ্গা চম্পক নগরে এসে উপনীত হলো। বেহুলা ডুমনীর বেশে শশুর গৃহে প্রবেশ করলেন। সনকা পুত্র বধূকে চিনতে পারলেন কিন্তু সপ্তপুত্র ও চৌদ্দ ডিঙ্গার সংবাদ পেয়ে আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন। চাঁদের নিকটও সংবাদ পৌঁছে গেল। চাঁদ খুশি হয়ে পুত্রগণকে আনতে গেলেন। তখন পুত্রগণ সমস্বরে বললেন
শোন,শোন,শোন, পিতা যাই তব ঘরে
ভক্তিভাবে তুমি যদি পদ্মা
পূজা কর
আমরা করেছি সত্য সাক্ষ্মীদেবগণ।।
তবে পদ্মা জিয়াইল ভাই
সপ্তজন
কৃপা করি দিলা মাতা চৌদ্দ
তরী ধন
প্রানদান পেল যত মাঝিমাল্লাগন।
যদ্যপি না পূজা কর, না
দেহ ফল জল
ধনজৃনসহ ডিভাঘাটে হবে
তল।
সকলের অনুরোধে তিনি অস্ফষ্ট স্বরে বললেন,বেশ পদ্মার পূজা আমি দিতে পারি
কিন্তু দক্ষিণ হস্তে নয় বাম হস্তে।
বন্ধুরা, ঠিক তখন থেকেই পৃথিবীতে পদ্মা দেবীর পূজার প্রচলন হলো। আমাদের
আজকের আর্টিকেলটি কেমন লাগলো, অবশ্যই সেটা জানাবেন। আমাদের পাশে থাকার জন্য আপনাদের
সবাইকে ধন্যবাদ।