প্রাকৃতিক মহাঔষধ কালোজিরার উপকারিতা ও অপকারিতা

 

কালোজিরা আমাদের বাঙালি রান্নার অন্যতম মসলা,যা পাঁচফোড়ন মসলার অপরিহার্য একটি উপাদান। রান্নায় ব্যবহৃত মসলার পাশাপাশি প্রাচীনকাল থেকেই কালোজিরা মানব দেহের বিভিন্ন রোগের মহা ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। আপনাদের সুস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে আমরা আজকে আপনাদের জানাবো এই প্রাকৃতিক মহা ঔষধ কালোজিরার পুষ্টিগুণ, উপকারিতা ও অপকারিতা। তাহলে বন্ধুরা প্রতিবেদনটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখতে থাকুন।


কালোজিরা আমাদের শরীরের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নিধান করে শরীরকে  সতেজ রাখে। এর ফুলের মধু ও তেল আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। তাহলে আসুন জেনে নেওয়া যাক কালোজিরা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য। 

সুচিপত্র : প্রাকৃতিক মহাঔষধ কালোজিরার উপকারিতা ও অপকারিতা। 


 কালোজিরা কি :

কালোজিরা হলো রান্নায় ব্যবহৃত এক ধরনের মসলা। এটা বিভিন্ন নামেও পরিচিত, যেমন - কালিজিরা, কালো কেওড়া, রোমান ধনে, নিজেল,কালঞ্জি এসব। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম হল - Nigella sativa linn। কালোজিরার আদি নিবাস দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া। তবে কেউ কেউ মনে করে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এর উৎপত্তিস্থল। কালোজিরা মাঝারি জাতীয় নরম মৌসুমী গাছ, যা একবার ফুল ও ফল হওয়ার পর মারা যায়। এর ফুল দুই ধরনের হয়, স্ত্রী ফুল ও পুরুষ ফুল। পাঁচ পাপড়ি বিশিষ্ট নীলচে সাদা রংয়ের হয়ে থাকে এই ফুল এবং এর বীজ ত্রিকোণা আকৃতির কালো রঙের হয়। বাংলা কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে এর ফুল ফোটে এবং শীতকালে ফল হয় ও শীতের শেষে ফল পাকে।

আরো পড়ুনঃ জেনে নিন রসুনের পুষ্টিগুণ , উপকারিতা ও অপকারিতা

কালোজিরার পুষ্টিগুণ :

কালোজিরা আয়ুর্বেদিক, কবিরাজি এবং ইউনানী চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এতে উপস্থিত রয়েছে প্রায় শতাধিক পুষ্টি ও উপকারী উপাদান। কালোজিরার মধ্যে থাকা অন্যতম প্রধান উপাদান গুলো হল - আমিষ রয়েছে  ২১ শতাংশ, শর্করা রয়েছে ৩৮ শতাংশ, ভেষজ ও তেল চর্বি রয়েছে ৩৫ শতাংশ। এছাড়া ভিটামিন পদার্থ পরিমাণ মতো বিদ্যমান। প্রতি গ্রাম  কালোজিরায় প্রোটিন  রয়েছে ২০৮ মাইক্রোগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১.৮৫ মাইক্রোগ্রাম, আয়রন ১০৫ মাইক্রোগ্রাম, ফসফরাস ৫.২৬ মিলিগ্রাম, কপার ১৮ মাইক্রোগ্রাম, জিংক ৬০ মাইক্রোগ্রাম, নিয়াসিন ৫৭ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি১ ১৫ মাইক্রোগ্রাম এবং ফোলসিন ৬১০ আইউ।

কালিজিরা থেকে যে তেল পাওয়া যায় তা আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। বর্তমানে কালোজিরা তৈরি ক্যাপসুলও বাজারে পাওয়া যায়। কালোজিরার তেলের উপস্থিত রয়েছেন ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন বি২, ভিটামিন সি, নিয়াসিন,ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফেট, ফসফরাস, আয়রন,জিংক, কার্বোহাইড্রেট, ফলিক অ্যাসিড, পটাশিয়াম, সেলেনিয়াম,ম্যাগনেসিয়াম, লিনোলিক অ্যাসিড এছাড়াও জীবাণুনাশক একাধিক উপাদান, যা আমাদের হাজারও উপকার করে।

কালোজির উপকারিতা :

কালোজিরা নিয়মিত ও পরিমিত সেবন করলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সতেজ হয় এবং সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। আমরা প্রায় সকলেই কালোজিরা চেয়ে থাকি কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই এর উপকারিতা সম্পর্কে জানে না। তাই আসুন এক নজর দেখে নেই কালোজিরার উপকারিতা গুলো -

১.রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে :

কালোজিরা আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ঔষধি গুনাগুন, যা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সতেজ রাখতে সক্ষম। প্রতিদিন ১ চামচ কালোজিরা অথবা এর তেল এবং ১ চামচ মধুসহ খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

২.উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে :

কালোজিরা তেলে রয়েছে উচ্চ থাইমোকুইনিন,যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। প্রাপ্তবয়স্করা হাফ চামচ করে দিনে দুইবার এই তেল খেলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসে।

৩. ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমায় :

কালোজিরার তেলে প্রচুর পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে যা আমাদের শরীরের উপকারী কোলেস্টেরল বাড়ায় এবং ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল কমায়।

৪.ক্যান্সার প্রতিরোধক :

ক্যান্সার প্রতিরোধক ক্যারোটিন ও শক্তিশালী হরমোন রয়েছে কালোজিরা। এটা ক্যান্সার রোগীদের জন্য খুবই উপকারী।

৫.লিভারের সমস্যা সমাধান করে :

কালোজিরা লিভারের বিভিন্ন রকম সমস্যা সমাধানে সক্ষম। এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় শরীরের প্রদাহ, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস করে এবং লিভারকে সুরক্ষিত রাখে।

আরো পড়ুনঃ দাঁত সম্পর্কে জানা-অজানা বিভিন্ন তথ্য

৬. কিডনির সমস্যা দূর করে :

শরীরের রাসায়নিক পদার্থের বিষাক্ততা কমাতে সক্ষম কালোজিরা। নিয়ম করে উষ্ণ পানির সঙ্গে পরিমাণ মতো কালোজিরার গুড়া এবং একটু মধু মিশিয়ে সেবন করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কমে।

৭.সর্দি কাশি সারায় :

সর্দি কাশির মতো সমস্যা থেকে কালোজিরা দ্রুত নিরাময় দেয়। কালোজিরার খুর সাথে মধু ও তুলসী পাতার রস মিশিয়ে সেবন করলে দ্রুত জ্বর ও সর্দি কাশি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

৮.স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করে :

কালোজিরা নিজেই একটি অ্যান্টিবায়োটি বা অ্যান্টিসেপটিক। মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মরণশক্তি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে কালোজিরা।

৯.ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে :

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখতে কালোজিরা খুবই উপকারী। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ১ গ্লাস পানির সাথে ১ চামচ কালো জিরার গুড়া সেবন করলে রক্তের গ্লুকোজ এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।

১০.শিশুর দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি করে :

শিশুর দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে কালোজিরা খুবই উপকারী। কালোজিরা শিশুর মস্তিষ্ক সুস্থ রাখে এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে।

১১.মায়ের বুকের দুধ বৃদ্ধি করে :

মায়ের বুকের দুধ বৃদ্ধিতে কালো জিরা একটি মহা ঔষধ। মায়েরা প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে ৫-১০ গ্রাম কালোজিরা মিহি করে দুধের সাথে খেলে ১০-১৫ দিনের মধ্যে দুধের প্রবাহ বেড়ে যায়।

১২.চুল পড়া কমায় :

সপ্তাহে কয়েকবার কালোজিরার তেল চুলে ব্যবহার করলে চুল পড়ার সমস্যা দূর হয়। কালোজিরা চুলের গোড়ায় পুষ্টি জোগাতে এবং চুলের গোড়া মজবুত করতে সক্ষম।

১৩.দাঁতের ব্যথা নিরাময় করে :

উষ্ণ গরম পানিতে কালোজিরা ভিজিয়ে রাখার পর সেই পানি দিয়ে কুলি কুচি করলে দাঁতের ব্যথা কমে যায় এবং জিহ্বা,তালু, দাঁতের মাড়ি জীবাণু নাশ হয়।

১৪.যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে :

কালোজিরা নারী-পুরুষ উভয়ের যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও যৌন সমস্যা প্রতিরোধ করে। প্রতিদিন কালোজিরা খাবারের সাথে খেলে পুরুষের স্পার্ম সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং পুরুষত্ব হীনতা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি করে।

আরো পড়ুনঃ ড্রাগন ফল কি সত্যিই উপকারী

১৫.অন্যান্য উপকারিতা :

কালোজিরা হল সর্ব রোগে মহা ঔষধ। উপরের সমস্যা গুলোর সমাধান ছাড়াও কালোজিরা আমাদের শারীরিক বহু সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে, যেমন - গ্যাসের সমস্যা দূর করে, ওজন কমাতে সাহায্য করে, ত্বকে উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে, হাড়ের ব্যথা কমায়, হাঁপানি থেকে মুক্তি দেয়, মেয়েদের অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা দূর করে, চর্মরোগ সারায়, আমাশয় নিরাময় করে, অর্শ রোগ নিরাময় করে, ভালো ঘুমোতে সাহায্য করে, বাতের ব্যথা দূর করে, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে  প্রভৃতি।

কালোজিরার অপকারিতা :

কালোজিরা উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না কিন্তু তা খেতে হবে নিয়মিত ও পরিমিত। অতিরিক্ত বেশি খেলে তা উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে।

১.গর্ভাবস্থায় কালোজিরা সেবন  করা যাবে না। এতে গর্ভপাত হতে পারে। তবে বাচ্চা প্রসবের পর স্তনের দুধ বৃদ্ধি জন্য কালোজির উপকারী।

২.২ বছরের কম বয়সী শিশুদের কালোজিরা না খাওয়ানোই ভালো। তবে বাহ্যিকভাবে কালোজিরা তেল ব্যবহার করা যাবে।

৩.কালোজিরা তেল অতিরিক্ত পরিমাণে ত্বকে লাগালে এলার্জি হতে পারে।

৪.অতিরিক্ত কালোজিরা সেবন করলে রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে যেতে পারে।

৫.কালোজিরা অতিরিক্ত সেবন করলে রক্তের জামাত বাধা কবম যেতে পারে।

আরো পড়ুনঃ পাবদা মাছ খাওয়ার উপকারিতা - পাবদা মাছের রোগ ও প্রতিকার

প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, কেমন লাগলো আমাদের আজকের এই প্রতিবেদনটি? আশা করি  কালোজিরা সম্পর্কীয় বিভিন্ন তথ্য আপনারা জানতে পেরেছেন। কালোজিরার পুষ্টিগুণ আশ্চর্যজনক ভাবে অতুলনীয়। তাই আপনাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কালোজিরা রাখতে চেষ্টা করবেন। সবার শুভ কামনা করে আজকের মত শেষ করছি, ধন্যবাদ।

আর্টিকেল রাইটারঃ প্রিয়াংকা কুণ্ডু


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url